• শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাচারি ঘর

Reporter Name / ১৬৩ Time View
Update : বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪

সাইফুল ইসলাম তরফদার (ময়মনসিংহ): এক সময়ের গ্রাম-বাংলার আভিজাত্যের প্রতীক। আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বা আভিজাত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত কাচারি ঘর এখন বিলুপ্তির পথে। গ্রাম-গঞ্জের হাতেগোনা দু’একটা বাড়িতে কাচারি ঘরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। তবে তা পড়ে আছে জরাজীর্ণ অবস্থায়।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাচারী ঘর বা বাংলা ঘর। ৯০ এর দশকে আগের আমলে প্রায় গ্রামের প্রায় বাড়িতেই ছিল কাচারি ঘর। বর্তমানে কালের পরিবর্তনে এ সংস্কৃতি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর আগের মতো ঐতিহ্যবাহী এ কাচারি ঘর দেখা যায় না।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রাম বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য,কৃষ্টি ও কালচারের অংশ কাচারি ঘর এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ১৩ টি ইউনিয়ন নিয়ে ফুলবাড়িয়া উপজেলা গঠিত। এই উপজেলায় অধিকাংশ ইউনিয়নের গ্রামের অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে আভিজাত্যের প্রতীক ছিল কাচারি ঘর বা গ্রামের বাংলা ঘর। বাড়ির বাহির আঙিনায় অতিথি, মুসাফির, ছাত্র ও জায়গিরদের থাকার এই ঘরটি কাচারি ঘর বা বাংলা ঘর ও বাহির বাড়ি ঘর নামে সমধিক পরিচিত ছিল।

কাচারি ঘর স্থাপিত হয় বাড়ির সামনে ঘাটায়। এতে বাড়ির সৌন্দর্য বাড়ায়। অতিথি, পথচারী, মুসাফির, সাক্ষাৎ প্রার্থী ও বাড়ির ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার ঘর হিসেবে ব্যবহার হতো। এখন আধুনিকতার যুগে গ্রামের বাড়ির সৌন্দর্য কাচারি ঘর সচারচর তেমন চোখে পড়ে না।

জানা গেছে, এক সময় গ্রাম-বাংলার অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থের আভিজাত্যের প্রতীক ছিল কাচারি ঘর। চারচালা টিনের অথবা শনের ছাউনি দিয়ে বাড়ির সামনে তৈরি হতো এ ঘর। কাচারি ঘরে থাকতেন আবাসিক গৃহশিক্ষক (লজিং/ জাগির মাস্টার বলতো)। সকাল বেলা মক্তব হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়া সালিশ-বৈঠক, গল্প-আড্ডা, পথচারী ও মুসাফিরদের বিশ্রামগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো কাচারি ঘর এবং বৃষ্টির দিনে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা খেলা ধুলা করতো।ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় কিছু বাড়িতে এখনও ঐতিহ্যবাহী পুরনো কাচারি ঘর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।যেমন ফুলবাড়িয়া সদর ইউনিয়নের আন্দারিয়াপাড়া গ্রামের মরহুম আনসার উদ্দিন সরকারের বাড়ি তার গড়া কাচারি ঘরটি এখনও ধরে রেখেছে তার সুযোগ্য পুত্র অধ্যক্ষ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম।

সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম তরফদার বলেন,আমার পড়া লেখার স্থান ছিল কাচারি ঘর। কাচারি ঘর থেকে লেখাপড়া করে আমি বড় হয়েছি।আমাদের বাড়ির পূর্ব-পুরুষের নানা স্মৃতি-বিজড়িত এ কাচারি ঘর সত্যিই প্রাচীন কালের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। তবে কালের বিবর্তনে এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।উপজেলার দক্ষিণ এলাকার শিক্ষার্থীরা আমাদের ফুলবাড়িয়া কলেজে এসে পড়ালেখা করতো।তারা উপজেলা সদরের দুই কিলোর মাঝে লজিং/ জাগির থাকতো।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকার একাধিক সমাজ সেবক আলাপকালে জানান, এক সময়ে একক বা যৌথ গৃহস্থ বাড়ির আভিজাত্যের প্রতীকই ছিল বাড়ির বাহির আঙিনার বৈঠকখানা; মানুষের কাছে যা কাচারি ঘর নামে পরিচিত ছিল।এ কাচারি ঘরের চৌকিতে থাকত বাড়ির অবিবাহিত ছেলে বা ছাত্ররা। আর মেহমান বা অতিথিরা এলে চৌকির ওপরে থাকতে দেয়া হতো। মাটিতে একঢালা হোগল পাতার বা বাঁশের চাটাই বিছিয়ে বিছানা করে থাকত বারোমাসি কামলারা (শ্রমিক) ও রাখাল । গড়গড় শব্দে তারা হুক্কা টানত আর ধোঁয়া ছাড়ত। প্রতি রাতেই পাড়ার সব কামলা/রাখাল বড় কোনো কাচারি ঘরে মিলিত হয়ে গানের আসর বসাতো। চলতো পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, রূপবান,গুনাই বিবি, আলোমতি, সাগরভাসা, বেহুলা লখিন্দরের পালা। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত বসত শালিস বৈঠক। গৃহ অভ্যন্তরে যারা থাকতেন তাদের চোখেও ঘুম ছিলো না, চা আর পানের ফরমায়েশ রক্ষা করতে।

ফুলবাড়িয়া পূর্ব মধ্যপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মাষ্টারের সুযোগ্য পুত্র সার্জেন্ট টি আই আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কাচারি ঘরের সামনের অংশে থাকতো বারান্দা। বারান্দায় সব সময় একটি হেলনা বেঞ্চ থাকত। ক্লান্ত পথিকরা এখানে বসে একটু জিড়িয়ে নিত।
কখনো কখনো পান-তামাক (হুক্কা) খেয়ে ক্লান্তির অবসাদ দূর করতো।এখন অধিকাংশ বাড়িতে কাছারি ঘর নেই। যে কয়টি আছে তা ব্যবহৃত না হওয়ায় অবহেলা, অযত্নে ধ্বংস প্রায়। অবকাঠামো ও যোগাযোগের উন্নতির ফলে মাঠে ঘাটে যারা কাজ করে তারা দিন শেষে নিজ বাড়িতে চলে যায়। পরিবার গুলো ছোট ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। তাই বিলুপ্তির পথে শতবর্ষের ঐতিহ্য কাচারি ঘর নামে খ্যাত বাহির বাড়ির বাংলো ঘরটি।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কৃতি সন্তান,লরেল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, চারদিকে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় গ্রাম বাংলার কাচারি ঘর এখন বিলুপ্ত প্রায়। তারপরও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য আমার বাড়ি ফুলবাড়িয়া সদর ইউনিয়নের আন্ধারিয়া পাড়া গ্রামে। আমার পিতা আনসার উদ্দিন সরকার তিনি ছিলেন একজন দলিল লেখক অত্র এলাকার সমাজ সেবক বাড়ির আঙ্গিনায় কাচারি ঘরটি রেখে যায়।সেই ঘরটির স্মৃতি আমরা রেখে দেই। উপজেলার কয়েকটি গ্রামের বাড়ির সামনে এখনো পুরনো সংস্কৃতি এ কাচারি ঘর স্মৃতি হিসেবে ধরে রেখেছে।প্রায় প্রতিটি রাতে কাচারি ঘরওয়ালা বাড়িতে আসত অনাত্মীয়- অচেনা কোনো মুসাফির। ভেতর বাড়ি থেকে শোনা যেত কোনো অচেনা মুসাফিরদের কণ্ঠ, “ বাড়িতে কেউ আছেন? থাকবার জায়গা হইবে। অনেক রাত হইছে,যেতে পারবো না।
যত রাতেই আসুক, অতিথিদের না খেয়ে শুতে দিত না বাড়িওয়ালারা। আবার এ সব অতিথিরা ভোররাতের অন্ধকার থাকতেই উঠে চলে যেত, এদের কারণে বাড়ির কোনো কিছু খোয়া যায়নি কোনো দিন।
গ্রামে আর বারোমাসি রাখালের প্রচলন নেই, নেই রাখালি গান। বাড়ির ছেলেদেরও রাতে ঘরের বাইরে থাকার অনুমতি নেই।

Facebook Comments Box


More News Of This Category
bdit.com.bd